আপনার ওয়েবসাইটে যে ৯টি বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরী

৯০ এর দশকের ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে ফোন ডিরেক্টরি নামে একটি সেবা চালু ছিলো। বিশাল আকারের এক বইয়ের ভেতর অনেক অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানাসহ তাদের সাথে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্যসহ তালিকা থাকতো। যে কেউ তার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান খুঁজে নিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করতো। 

এই ফোন ডিরেক্টরিতে কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকলে সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নতুন গ্ৰাহক পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যেতো। আর এই সময়ে এসে আপনার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট আপনার নতুন গ্রাহক পাবার অন্যতম একটি মাধ্যম সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

এক জরীপে দেখা যায়, ২০২৪ সালের বিশ্বব্যাপী মোট খুচরা বিক্রির ২০.৮% হবে ইকমার্স বা অনলাইন শপগুলোর মাধ্যমে আর অনলাইনে কেনাকাটার পরিমাণ বাড়ছে প্রতিবছরই। সহজে বললে প্রতি ১০০ টাকা খুচরা কেনাকাটার ভেতরে ২১ টাকাই হবে অনলাইনে। তাই, আপনার যদি নিজস্ব দোকান থাকেও, তবুও একটা ভালো ওয়েবসাইটের কোনো বিকল্প নেই।

কিছুটা দেরিতে হলেও এখন অনেকেই তার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করেন। তবে ছোটোখাটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় লক্ষ্য না করার জন্য, ওয়েবসাইটের সুবিধাগুলো ভালোভাবে উপভোগ করতে পারেন না। তাই আপনার ওয়েবসাইট তৈরির সময় কোন বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখবেন সেটাই সহজভাবে তুলে ধরবো এখানে।

  • সহজ নেভিগেশন / হাতের কাছেই রাখুন সবকিছু 
  • রেসপনসিভ ডিজাইন গুরুত্বপূর্ণ 
  • আকর্ষণীয় ডিজাইনসহ ভালো অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করুন 
  • ভালো লোডিং স্পিড দরকার 
  • গুরুত্বপূর্ণ পেইজ (আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, গ্ৰাহক তালিকা ইত্যাদি) থাকা খুবই জরুরি 
  • সার্চ ইঞ্জিনের কথা মনে রাখুন 
  • তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করুন
  • ভালো CTA (Call to Action) লিখুন 
  • ভালো ওয়েবসাইট সিকিউরিটি নিশ্চিত করুন

১। সহজ নেভিগেশন / হাতের কাছেই রাখুন সবকিছু

একজন ব্যক্তি যখন আপনার ওয়েবসাইট ভিজিট করবে তখন তিনি যেনো সহজেই ওনার প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।

হেডার: প্রতিটি ওয়েবসাইটের একেবারে শুরুর দিকে থাকে হেডার অংশটি। এই হেডারের ভেতরেই থাকে মূল মেন্যু। মূল মেন্যুতে সাধারণত নিচের আইটেমগুলো থাকে।

  • হোম
  • অ্যাবাউট / প্রতিষ্ঠান পরিচিতি 
  • যোগাযোগ
  • শপ / অনলাইনে কেনাকাটা 
  • প্রতিষ্ঠানের সেবা সমূহ
  • ব্লগ

সার্চ বার : ওয়েবসাইটে চটজলদি যেকোনো তথ্য খুঁজে পেতে সার্চ বার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই আপনার গ্ৰাহকের সুবিধার জন্য অবশ্যই রাখুন।

ছবি কৃতজ্ঞতা : Mikael Blomkvist

ফুটার : সাধারণত ওয়েবসাইটের একেবারে নিচের দিকে এই অংশটি থাকে। আপনার ওয়েবসাইটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেইজের লিঙ্ক যেমন ওয়েবসাইট ব্যবহারের শর্তাবলী (Terms of use), গোপনীয়তার নীতিমালা (Privacy policy), যোগাযোগের বিস্তারিত ইত্যাদি এই অংশে রাখতে পারেন।

২। রেসপনসিভ ডিজাইন গুরুত্বপূর্ণ

রেসপনসিভ ডিজাইন আপনার ওয়েবসাইটকে যেকোনো ডিভাইসে, যেকোনো স্ক্রিনে আপনার ওয়েবসাইটকে সুন্দর ও সহজভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তুলবে। 

এ মুহূর্তে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি ওয়েবসাইট ভিজিট হয় মোবাইল ডিভাইসগুলো থেকে। বিশেষ করে আপনি যদি আপনার ওয়েবসাইট বা অনলাইন শপকে ফেসবুকসহ অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়াতে প্রচারণা করেন, তাহলে ওয়েবসাইটের এই সুবিধাটি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। Think with Google এর এক গবেষণা অনুযায়ী, ৭৯ শতাংশ ব্যবহারকারী মোবাইলে সহজে ব্যবহার করা যায় এমন ওয়েবসাইটকেই অন্যদের সাথে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

তাই ওয়েবসাইট ডেভলপারের থেকে বুঝে নেবার সময় লক্ষ্য রাখুন গুরুত্বপূর্ণ এই সুবিধাটি আপনার ওয়েবসাইটের আছে কিনা। 

৩। আকর্ষণীয় ডিজাইনসহ ভালো অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করুন 

 আপনার ওয়েবসাইট আপনার সম্পদ, তাই ওয়েবসাইট তৈরির সময় চিন্তা করুন কিভাবে এটাকে সহজ এবং আকর্ষণীয়ভাবে আপনার গ্ৰাহকদের কাছে তুলে ধরা যায়। চিন্তা করুন, একজন গ্ৰাহক বা সম্ভাব্য গ্ৰাহক আপনার ওয়েবসাইটে এসে কি খুঁজতে পারে, কি প্রয়োজন হতে পারে। ঠিক সে অনুযায়ী ওয়েবসাইটকে সাজানোর চেষ্টা করুন।

আমরা অনেকেই ওয়েবসাইট তৈরির সময় এ বিষয়গুলো পুরোপুরি ডেভেলপারের উপরে ছেড়ে দিই! মনে রাখবেন, আপনার গ্ৰাহককে সবচেয়ে ভালো আপনিই চেনেন, ডেভেলপার নয়। 

আপনি যদি আপনার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মতো একই ধরনের অন্যকিছু প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ভিজিট করেন তাহলে আপনার জন্য এ কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি ডেভেলপারের সাথে গঠনমূলক আলোচনাও বেশ ফলপ্রসূ হতে পারে।

৪। ভালো লোডিং স্পিড দরকার

একটি ওয়েবসাইটকে গুগল সার্চ রেজাল্টের শুরুর দিকে আনতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চেষ্টা করুন সর্বোচ্চ ৪-৫ সেকেন্ডের মধ্যেই যেনো আপনার ওয়েবসাইটটি লোড হয়ে যায়। এতে আপনার ভিজিটর বিরক্ত হবে না। অনলাইনে কিছু টুলস আছে, যেগুলো দিয়ে সহজেই আপনার সাইটের স্পিড মাপতে পারবেন।

ওয়েবসাইটে ছোট আকারের ছবি দ্রুত লোড হওয়ার জন্য খুবই জরুরি। আর লেজি লোডিংসহ নতুন সুবিধাগুলোও ওয়েবসাইটকে দ্রুত লোডিং এ সহায়তা করে।

৫। গুরুত্বপূর্ণ পেইজ (আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, গ্ৰাহক তালিকা ইত্যাদি) থাকা খুবই জরুরি

ওয়েবসাইট তৈরি করলেও আমাদের দেশে এখনো নিজের প্রতিষ্ঠানকে ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করাকে এখনো গুরুত্বের সাথে নেয়া হয় না, শুনতে অদ্ভুত শোনালেও একথা সত্য। প্রায় সময়েই দেখা যায়, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পেইজ থেকে হবহু বা সামান্য পরিবর্তন করে লিখে দেয়া হয়। এই ধরনের কাজ খুবই ক্ষতিকর, আপনার ওয়েবসাইট এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য।

আপনি যদি আপনার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের সঠিক উপস্থাপন আপনার গ্ৰাহকের সামনে করতে ব্যর্থ হন, তাহলে গ্ৰাহক কেন আপনার সেবা বা পণ্য নিতে চাইবে? তাই, অবহেলা না করে আপনার প্রতিষ্ঠানের শক্তি আর অর্জনের কথাগুলো সুন্দর করে তুলে ধরুন।

সম্ভব হলে, প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ছবিসহ লেখা দিন। ইন্টারনেট থেকে যেকোনো একটি ছবি নিয়ে এখানে দিয়ে দিলে আপনার প্রতিষ্ঠান আর অন্য দশটি  প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনো পার্থক্য থাকে না। মূল ব্যক্তিদের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা আলাদাভাবে তুলে ধরুন। 

৬। সার্চ ইঞ্জিনের কথা মনে রাখুন

আপনি অনেক যত্ম করে ওয়েবসাইট তৈরি করলেন, কিন্তু গুগল বা অন্য কোনো সার্চ ইঞ্জিন আপনার ওয়েবসাইটকে তাদের রেজাল্ট পেইজে দেখায় না! এমন হলে আপনার আসলেই নড়েচড়ে বসা উচিত। কারণ, সার্চ ইঞ্জিনে আপনার সাইট না দেখানো মানে আপনি নিশ্চিতভাবেই নতুন অনেক গ্ৰাহক হারাচ্ছেন!!

ছবি কৃতজ্ঞতা : Brett Jordan

আর সার্চ ইঞ্জিনে দেখানোর প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয় ওয়েবসাইট তৈরির সময় থেকেই; তৈরির পর থেকে না। একজন ভালো ওয়েব ডেভেলপার ওয়েবসাইট তৈরির সময়ই এ বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করেন। তাই সময় থাকতেই এ বিষয়ে ডেভলপারের সাথে কথা বলুন।

তবে অনেকেই ভাবেন, ওয়েবসাইট তৈরির সাথে সাথেই গুগলসহ অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন ওয়েবসাইটিকে দেখানো শুরু করবে। এটা একেবারেই ভুল ধারণা, সার্চ ইঞ্জিনকে গুরুত্ব দিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করলেও তা সার্চ ইঞ্জিনের রেজাল্ট পেইজে দেখাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে।

৭। তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করুন 

ভালো ওয়েবসাইটের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর বিভিন্ন তথ্য হালনাগাদ থাকবে। এতে আপনার গ্রাহক যেমন বারবার ওয়েবসাইটে আসতে আগ্রহী থাকবে ঠিক তেমনি আপনার প্রতিষ্ঠানের নতুন পণ্য বা সেবা সম্পর্কেও গ্রাহক জানতে পারবে সহজেই।

এর পাশাপাশি ওয়েবসাইটের বিভিন্ন প্লাগইন আপডেট করার মাধ্যমে ওয়েবসাইটকে হ্যাকিং এর হুমকি থেকে নিরাপদ রাখতে পারবেন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়েব ব্রাউজারে আপনার ওয়েবসাইটটি ঠিক মতো দেখাচ্ছে কিনা সেটার দিকেও লক্ষ্য রাখা ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করার মধ্যে করতে পারেন।

৮। ভালো CTA (Call to Action) লিখুন

নিজেকে প্রশ্ন করুন, একজন ভিজিটর আপনার ওয়েবসাইটে আসার পর আপনি তাকে দিয়ে কি করাতে চান? হতে পারে আপনি চাচ্ছেন, ভিজিটর আপনার কোনো পণ্য কিনুন বা ওনার বিস্তারিত তথ্য দিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ করুক বা আপনাকে সরাসরি ফোন করুক।

সহজভাবে বললে, CTA (Call to Action) হচ্ছে আপনি আপনার ওয়েবসাইটে আপনার ভিজিটরকে দিয়ে যা করাতে চান সেদিকে ভিজিটরের আগ্ৰহ তৈরি করা। এজন্য CTA এমনভাবে লেখা উচিত যাতে ভিজিটর খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি যা চাচ্ছেন ঠিক সেটাই করে।

মনে রাখবেন,ওয়েবসাইটের প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই পরিস্কার ভাবে CTA না থাকলে আপনার ভিজিটর গ্ৰাহকে পরিণত হবার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকটাই।

৮। ভালো ওয়েবসাইট নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

সাইবার দুনিয়ায় এখন হ্যাকিং একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভালো নিরাপত্তা ছাড়া একটি ওয়েবসাইটকে সম্পূর্ণ বলা যায় না। 

আপনার ওয়েবসাইটকে নিরাপদ রাখতে সাধারণ কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখুন :

  • ওয়েবসাইটে ব্যবহার করা সফটওয়্যার এবং বিভিন্ন প্লাগইন নিয়মিত হালনাগাদ করুন।
  • ওয়েবসাইটের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদি কোনো অ্যাকাউন্ট থাকে তবে এসব অ্যাকাউন্টের জন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড নির্বাচন করুন। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করতে এবং সংরক্ষণ করতে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন। ভালো পাসওয়ার্ড ম্যানেজার সম্পর্কে জানতে দেখে নিতে পারেন আমাদের এই লেখাটি।
  • অবশ্যই SSL certificate ব্যবহার করুন। বিনামূল্যে অথবা কিনে যেটাই হোক না কেনো SSL certificate ব্যবহার না করলে বড় ধরণের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে আপনার ওয়েবসাইটটি।

একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তৈরির সময় উপরের বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখলে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি আধুনিক ও কার্যকরী ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারবেন, যা আপনার ব্যবসার গতি বাড়াবে অনেকটুকু। 

ওয়েবসাইট তৈরির সময় আপনার অভিজ্ঞতা এবং নতুন কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় আপনার জানা থাকলে কমেন্টে জানাবার অনুরোধ থাকলো।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *