ইনভার্টার ফ্রিজ কি? ইনভার্টার নাকি সাধারণ ফ্রিজ, কোনটা ভালো?

বিষয়টা একেবারে নতুন নয়। গত ২-১ বছর থেকেই বাজারে ইনভার্টার ফ্রিজ নামে নতুন এক ধরণের ফ্রিজ পাওয়া যাচ্ছে। শুধু পাওয়াই যাচ্ছে না বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বেশ দামী ফ্রিজগুলোতে এ সুবিধা দিলেও এখন দেশি ব্র্যান্ডগুলোও এ ইনভার্টার সুবিধাযুক্ত বেশ কিছু মডেলের ফ্রিজ বাজারে নিয়ে এসেছে এবং সব মিলিয়ে এই ইনভার্টার প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ফ্রিজের মডেলের সংখ্যা বাড়ছে। দেশি ব্র্যান্ডগুলো আবার মাঝারিদামের কিছু ফ্রিজেও এ সুবিধা দেয়াতে, নতুন এই প্রযুক্তি এখন অনেকেই হাতের নাগালে। কিন্তু তারপরও, দেখা যাচ্ছে এ ফ্রিজগুলোর দাম সাধারণ ফ্রিজের চেয়ে কিছুটা বেশি। যেমন ধরুন, ২০৮ লিটারে একটি সাধারণ ফ্রিজের তুলনায় ২০৮ লিটারের একটি ইনভার্টার ফ্রিজের দাম বেশ খানিকটা বেশি। এ কারণেই অনেকেই আজকাল এই প্রশ্নটি করেন যে, আসলেই কি ইনভার্টার ফ্রিজ ভালো হবে? বেশি দাম দিয়ে এ ধরণের ফ্রিজ কেনার আসলেই অর্থ আছে নাকি শুধু শুধু টাকা নষ্ট? আমরা আজ বোঝার চেষ্টা করবো আসল ব্যাপারটা।

ফ্রিজের ক্ষেত্রে একটি মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন কি, সাধারণত একটি বাসায় ১টি বা ২টি ফ্রিজ থাকে এবং সেই ফ্রিজের ব্যবহারকারী থাকে বাসার প্রায় সবাই। সারাদিনই সকলে মিলে যার যখন প্রয়োজন তখন ফ্রিজ ব্যবহার করে থাকে। আর ফ্রিজ ব্যবহার মানেই সারাদিন অসংখ্যবার ফ্রিজের দরজা খোলা আর বন্ধ করা। অনেকবার দরজা বন্ধ আর খোলার কারণে ফ্রিজের মূল যন্ত্রাংশ অর্থাৎ কম্প্রেশারকে চলতে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এজন্য ফ্রিজের বিদ্যুৎ খরচও হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। শুধু তাই না, ফ্রিজ এমন একটি যন্ত্র যা কিনা দিনে ২৪ ঘন্টা, বছরে ৩৬৫ দিন চলতে থাকে, যেটা কিন্তু আমাদের বাসার অন্য কোন ইলেকট্রনিক্স পণ্য চলে না। এখানেই চলে আসে ইনভার্টার ফ্রিজের ব্যাপারটা, কারণ বলা হয় এ প্রযুক্তির ফ্রিজ বিদ্যুৎ খরচ কমায়। যে যন্ত্র সারাদিন, সারাবছর চলে সে যন্ত্র যদি কম বিদ্যুৎ খরচ করে, তাহলে আপনার বিদ্যুৎ বিলও যে অনেকটুকু কমবে সেকথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে, চলুন দেখে নেয়া যাক ইনভার্টার ফ্রিজ কি?

ইনভার্টার ফ্রিজ কি?

আসলে ইনভার্টার ফ্রিজ নামটি এসেছে কারণ এই ফ্রিজের কম্প্রেশারটি হচ্ছে ইনভার্টার প্রযুক্তি সম্পন্ন। এই ধরনের কম্প্রেশারের বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি প্রয়োজন অনুযায়ী গতি পরিবর্তন করতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে স্বল্প গতিতে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। এমন নয় যে ইনভার্টার ফ্রিজের কম্প্রেশার সবসময় চলতেই থাকে, সাধারণ ফ্রিজের মতো এটিও প্রয়োজন অনুযায়ী বন্ধ হয় এবং চালু হয়। কয়েকটি বিশেষত্বের মধ্যে, ইনভার্টার ফ্রিজের একটি মজার বিশেষত্ব হচ্ছে এটি ব্যবহারকারীর ব্যবহারের ধরণ বুঝতে পারে এবং এর উপর নির্ভর করে, এর ইনভার্টার কম্প্রেশারের গতি এবং চালু কিংবা বন্ধ হওয়াও নিয়ন্ত্রণ করে। ধরুন, কোন কারণে আপনার ফ্রিজের দরজা বেশি সময় খোলা রাখতে হচ্ছে, সেসময় ইনভার্টার ফ্রিজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এর ইনভার্টারের গতি বাড়িয়ে খাবার ঠান্ডা রাখবে, আবার কম সময় দরজা খোলা রাখলে সেসময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর ইনভার্টারের গতি প্রয়োজন অনুযায়ী কমিয়ে দেবে। কিন্তু সাধারণ ফ্রিজে তাপমাত্রা কমিয়ে দিলে দেখা যায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঠান্ডা হচ্ছে, আবার তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলে দেখা যায় খাবার-দাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

আবার, রাতের বেলায় ঘটে ভিন্ন ঘটনা। এসময়ে ফ্রিজের দরজা প্রায় খোলা হয় না বললেই চলে। তাই এসময়ে ইনভার্টার কম্প্রেশারটিও চলে অনেক ধীর গতিতে, ঠিক যতটুকু না হলেই নয়। তাই এখানে বিদ্যুৎ করচ কমে যায় অনেকটুকু।

সাধারণ ফ্রিজ কি?

আসলে সাধারণ ফ্রিজ কি, সেটা নিয়ে খুব বেশি কথা বলবো কারণ আমরা সবাই কম-বেশি জানি এ ধরণের ফ্রিজ সম্পর্কে। তবুও ইনভার্টার ফ্রিজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে সাধারণ ফ্রিজের মূল কিছু বিষয় তুলে ধরা উচিত।

সাধারণ ফ্রিজে যে ইনভার্টার ব্যবহার করা হয় সেগুলো ইনভার্টার কম্প্রেশারের মতো গতি পরিবর্তন করতে পারে না। এরা নির্দিষ্ট গতিতে চলে, কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি পরিবর্তন করতে পারে না। এটি নির্দিষ্ট সময় পর পর চালু কিংবা বন্ধ হবার মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য লক্ষ্য করলে দেখবেন, সাধারণ ফ্রিজগুলো কিছুক্ষণ বেশ শব্দ করে চলে, এরপর একেবারে নিঃশব্দ হয়ে যায়।

ইনভার্টার বনাম সাধারণ ফ্রিজ

চলুন আমরা ইনভার্টার এবং সাধারণ ফ্রিজের সুবিধা-অসুবিধাগুলো পাশাপাশি দেখি, যাতে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে ভালো হবে।

  • সাধারণ ফ্রিজ একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলতে থাকে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায় আসতে যতক্ষণ লাগবে ততক্ষণ পর্যন্ত, এরপর বন্ধ হয়ে আবার প্রয়োজন অনুযায়ী চালু হয়। অন্যদিকে ইনভার্টার ফ্রিজের কম্প্রেশার কম গতিতে চলতে পারে দীর্ঘক্ষণ ধরে, কম গতিতে চলার কারণে বিদ্যুৎ খরচ হয় কম এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ভালোভাবে হয় সাধারণ ফ্রিজের চেয়ে।
  • সাধারণ ফ্রিজ যদি সারাদিনে কিছুটা বেশি ব্যবহার হয় তাহলে কম্প্রেশার বেশি সময় ধরে চলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, এতে কম্প্রেশারের উপর চাপ পড়ে বেশি, চাপ বেশি পড়লে নষ্ট হবার সম্ভাবনাও থাকে। পাশাপাশি, ইনভার্টার ফ্রিজ সারাদিনে কম বা বেশি ব্যবহার খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজের চলার গতি নিয়ন্ত্রণ করে, তাই এর উপর চাপ পড়ে কম, নষ্ট হবার ভয়ও কম থাকে।
  • সাধারণ ফ্রিজের কম্প্রেশারের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে বারবার চালু ও বন্ধ হয়, ফলে বিদ্যুৎ খরচ হয় বেশি। অন্যদিকে, ইনভার্টার ফ্রিজ গতি কমিয়ে বা বাড়িয়ে চলতে থাকে, বারবার চালু ও বন্ধ হয় না, তাই বিদ্যুৎ খরচ হয় সাধারণ ফ্রিজের তুলনায় অনেক কম।
  • সাধারণ ফ্রিজের কম্প্রেশার প্রতিবার চালু হবার সময় বেশ কিছুটা শব্দ করে, অন্যদিকে ইনভার্টার ফ্রিজের কম্প্রেশার ধীরগতিতে দীর্ঘসময় চলার কারণে এবং স্বল্পগতিতে চালু হবার কারণেও এটি চালু হয় খুব অল্প শব্দ হয়।

এত আলোচনা শেষে, আপনি কোন ফ্রিজ কিনবেন বা কোন ফ্রিজ আপনার জন্য সে সিদ্ধান্ত নিতে আশা করি খুব বেশি অসুবিধা হবে না। আমার দেখা অনুযায়ী, শুরুতে খরচ কিছুটা বেশি হলে দীর্ঘমেয়াদে ইনভার্টার ফ্রিজের খরচ কম। সবকিছুর পর সিদ্ধান্ত আপনার আপনি কি শুরুতে কিছুটা বেশি খরচ করবেন নাকি সবসময় বিদ্যুৎ বিল বেশি দেবেন। তবে আপনি যদি ইনভার্টার ফ্রিজ কিনতে চান তাহলে নিচের দুটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরী :

  • ইনভার্টার ফ্রিজ কিনলে ফ্রিজটি প্রথমবার ঠান্ডা হতে কিছুটা সময় বেশি লাগছে বলে মনে হতে পারে। এর কারণ হতে পারে, প্রাথমিকভাবে কম গতিতে কম্প্রেশার চালু হওয়া। এটা ইনভার্টার ফ্রিজের একটি ছোট সমস্যা বলে ধরতে পারেন।
  • আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখবেন যে ফ্রিজটিতে R600A গ্যাসটি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। চেষ্টা করুন এই গ্যাস ব্যবহার হয়েছে এমন ফ্রিজ কিনতে, কারণ এ গ্যাসটির পরিবেশগত ঝুঁকি সবচেয়ে কম আর বিদ্যুৎ খরচও বেশ কম।

অনেক কথার পরে আমরা একেবারে শেষদিকে চলে এসেছি। ইনভার্টার এবং সাধারণ ফ্রিজের মধ্যে কোনটি আপনার পছন্দ, কেন পছন্দ এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন আমাদের সাথে, যাতে আমরা আরো নতুন নতুন ভালো লেখা আপনাদের সামনে নিয়ে আসতে পারি।

You may also like...

4 Responses

  1. Mohammed Ferdous says:

    ইনভেটার ফ্রিজে কি R600a গ্যাস টি ব্যবহার ভালো না খারাপ? 134a এই গ্যাস তো ভারি তাই বিদ্যুৎ খরচ বেশি আসে। একটু জানাবেন প্লিজ।

    • Faisal Ahmed says:

      আজকাল আধুনিক ফ্রিজগুলোতে R600A গ্যাসটিই বেশিবভাগ সময়ে ব্যবহার করা হয়। এই গ্যাস ব্যবহার হয়েছে এমন ফ্রিজ নিয়ে নিতে পারেন নিশ্চিন্তে।

  2. BABUL ISLAM says:

    চমৎকার লাগলো।

    • Faisal Ahmed says:

      অনেক ধন্যবাদ 😊। অন্যান্যদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ থাকলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *